ব্যাক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় একটা স্মার্টফোনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে এর ডিসপ্লে। কারন হিসেবে বলা যেতে পারে আপনার ফোনের CPU, GPU, যতই শক্তিশালী/দূর্বল হোক এর আউটপুট কিন্তু বেশিরভাগ আমরা ডিসপ্লেতেই পাই। বর্তমানে স্মার্টফোনে বিভিন্ন ধরনের ডিসপ্লে ব্যাবহার করা হয়। তারমধ্যে জনপ্রিয় কিছু ডিসপ্লে নিয়ে আজকে সংক্ষেপে বলবো। ডিসপ্লে সম্বন্ধে বুঝতে হলে এর টাইপ জানার আগে অবশ্যই Resolution ও PPI নিয়ে জানতে হবে।
★Display Resolution:- ডিসপ্লের রেজুলেশনের হিসেবে কয়েক ধরনের ডিসপ্লে দেখতে পাওয়া যায়। সব ধরনের ডিসপ্লেতেই অনেক অনেক গুলা ছোট্ট ছোট্ট পিক্সেল (Pixel- Picture Element) থাকে। প্রত্যেকটা পিক্সেলে আবার তিনটা করে সাব পিক্সেল থাকে। সাব পিক্সেল গুলা একটা লাল, একটা সবুজ এবং আরেকটা নীল হয়। আমরা জানি এই তিনটা মৌলিক রঙ দিয়ে যেকোন রঙ তৈরি করা সম্ভব। তাই প্রত্যেকটা পিক্সেল ই আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন রঙ দেখানোর ক্ষমতা রাখে। আধুনিক ভালো মানের ডিসপ্লে তে এই পিক্সেল এর গুলা আমরা খালি চোখে আলাদা করতে পারি না। তবে আগের টিভি বা ক্যালকুলেটর এর স্ক্রিন এ দেখলে পিক্সেল গুলা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এবার রেজুলেশন নিয়ে সংক্ষেপে বলা যাক-
ইমেজ ক্রেডিটঃ মিডিয়াম
★HD Display:- যেসব ডিসপ্লের রেজুলেশন (1280 x 720) ওইগুলাকে HD বা High Definition ডিসপ্লে বলে।
★Full HD Display:- যেসব ডিসপ্লের রেজুলেশন (1920 x 1080) ওইগুলাকে হচ্ছে Full HD ডিসপ্লে।
★QHD Display:- (2560 x 1440) এই রেজুলেশনের ডিসপ্লে কে বলা হয় QHD বা Quad HD ডিসপ্লে। অর্থাৎ চার টা HD ডিসপ্লেতে যেই পরিমান পিক্সেল থাকে (৩৬৮৬৪০০ টা) একটা Quad HD ডিসপ্লেতে সমপরিমাণ পিক্সেল থাকে।
4K Display:-
ইমেজ ক্রেডিটঃ ডেভিড স্মিথ
বর্তমান সময়ে আবার ডিসপ্লেতে দৈর্ঘ্য প্রস্থের অনুপাতের ভিন্নতা (১৮:৯, ১৯:৯ ইত্যাদি) কারনে দেয়া যায়। এর জন্য রেজুলেশনেও নতুন কিছু হিসাব যোগ হয়েছে। যেমন HD+, FHD+ ইত্যাদি। ডিসপ্লের রেজুলেশন যতো বেশি হবে ডিসপ্লে ততো শার্প হবে।
★★★PPI:- PPI মানে হচ্ছে Pixel Per Inch অর্থাৎ ডিসপ্লের প্রতি ইঞ্চিতে কতোটা পিক্সেল আছে এইটা বুঝানোর হয় PPI দিয়ে। PPI ডিসপ্লের সাইজ ও রেজুলেশন এই দুইটা জিনিসের উপর নির্ভর করে। এবার আমরা একটা সাধারন হিসাব শিখি যে PPI টা হিসাব করে কিভাবে? ধরা যাক একটা ৫” সাইজের ডিসপ্লেতে FHD রেজুলেশন দেয়া হয়েছে। তার মানে এর দৈর্ঘ্য তে পিক্সেল আছে ১৯২০ টা, আর প্রস্থে পিক্সেল আছে ১০৮০ টা। এবার PPI হিসাব করতে হলে আমাদের ডিসপ্লে এর কোণাকোণি কত পিক্সেল আছে এইটা বের করতে হবে। এর জন্য আমাদের একটু ত্রিকোণমিতির অংক কষতে হবে। ডিসপ্লের কোনাকোনি যদি আমরা একটা রেখা কল্পনা করি তাহলে সেটা হবে অতিভুজ এবং এটি ৫”।
(১৯২০*১৯২০)+(১০৮০*১০৮০)=৪৮৫২৮০০, এইবার এই যোগফলটার (৪৮৫২৮০০) বর্গমূল বের করে সেই বর্গমূল কে ৫ (ডিসুলে যতো ইঞ্চি) দিয়া ভাগ করতে হবে। অর্থাৎ ২২০২.৯১÷৫=৪৪০.৫৮(৪৪১) প্রায়। অর্থাৎ এই এই ডিসপ্লে টার প্রতি ইঞ্চিতে ৪৪১ টা পিক্সেল আচ্ছে। অর্থাৎ এইটার PPI 441। সহজে আরেকবার বললে, রেজুলেশন দুইটার বর্গের যোগফোল বের করতে হবে। ওই যোগফলের বর্গমূল বের করতে হবে। বর্গমূলকে ডিসপ্লের সাইজ দিয়ে ভাগ করতে হবে। যেই ভাগফল পাওয়া যাবে ওইটাই হবে PPI বা Pixel per inch. PPI কম হলে ফোনের বিভিন্ন কন্টেন্ট বিশেষ করে টেক্সট গুলা ভালোভাবে ফুটে উঠে না। PPI বেশি হলে সব কিছুই শার্প দেখা যায়।
পিপিআই ইমেজ ক্রেডীটঃ গিফগাফ
♠ডিসপ্লে টেকনলজির উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক রকম ডিসপ্লে হয়-
★LCD Display:- LCD এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Liquid Crystal Display। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ ফোনেই এই টাইপের ডিসপ্লে দেয়া হয়। মূলত মোবাইল ফোনে দুই ধরনের LCD ব্যাবহার করা হয়। LCD ডিসপ্লেতে চার টা স্তর থাকে। সবচেয়ে নিচের স্তর থেকে আলো আসে আর সবচে উপরে কালার ফিল্টার থাকে। আর মাঝে দুইটা পোলারাইজ ফিল্টার থাকে।
*IPS LCD Display:- LCD ডিসপ্লের মধ্যে IPS LCD ডিসপ্লে সবচেয়ে ব্যাবহৃত। IPS এর পুর্নরুপ হলো In-Plane Switching. মিডরেঞ্জের ফোন থেকে শুরু করে কিছু কোম্পানির ফ্ল্যাগশিপে পর্যন্ত এই ডিসপ্লে ব্যাবহার করা হয়। একদম ন্যাচারাল কালার, এক্সট্রিম ভিউইং এঙ্গেল, বেটার কন্ট্রাস্ট দিতে পাতে এই ডিসপ্লে। প্রায় ১৭০-১৭৫ ডিগ্রী কোণেও এই ডিসপ্লেতে কোন নেগেটিভিটি দেখা যায় না। এছাড়াও বাস্তবসম্মত কালার দেয় এইটা। অতিরিক্ত কালারফুল ও না, আবার ডাল কালার ও না। এই ডিসপ্লের ব্রাইটনেস ও বেশি থাকে তাই রৌদ্রে বা অনেক উজ্জ্বল আলোকিত জায়গায় ও এই ডিসপ্লেতে কন্টেন্ট দেখতে তেমন অসুবিধা হয় না। এই ডিসপ্লের পুরুত্ব কম হওয়ায় ফোন ও স্লিমভাবে তৈরি করা যায়। তবে এইটার নিচের দিকে আলো পুরুটা সবসময় জ্বলে থাকে। তাই AMOLED ডিসপ্লে এর তুলনায় এইটা বেশি বিদ্যুৎ খরচ করে।
*TFT LCD Display:- এইটা অনেক পুরানো প্রযুক্তির ডিসপ্লে। ডিজিটাইজার থেকে এইটা স্ক্রিন এর মাঝে কিছুটা ফাকা থাকে, তাই মনে হয় ডিসপ্লে টা কেমন একটু নিচের দিকে আছে। কালার খুব একটা ভালো পাওয়া যায় না, এই ডিসপ্লের ভিউইং এঙ্গেল খুব খারাপ হয়ে থাকে। একটু পাশ থেকে তাকালেই ডিসপ্লে নেগেটিভ দেখা যায়। আবার এই ডিসপ্লে পাওয়ার ও খরচ করে বেশি। সাধারণত বাজেট ফোনে বা একদম ই কমদামী ফোনে এই ডিসপ্লে ব্যাবহার করা হয়। এই ডিসপ্লে IPS ডিসপ্লের তুলনায় তুলনামূলক মোটা। তাই এই ডিসপ্লেযুক্ত ফোন ততটা স্লিম হয় না।
★AMOLED Display:- AMOLED এর পুর্নরুপ হলো Active Matrix Organic Light Emitting Diode. এমোলেড ডিসপ্লের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইটার প্রত্যেকটা পিক্সেলের আলাদাভাবে জ্বলা বা নিভার ক্ষমতা আছে। অর্থাৎ যেই পিক্সেল গুলা জ্বলার দরকার সেগুলা জ্বলবে বাকিগুলা জ্বলবে না। এইটার কারনে সুবিধা পাওয়া যায় তিনটা। প্রথমত, যেহেতু অপ্রয়োজনীয় পিক্সেল গুলা জ্বলে না তাই এতে ব্যাটারি সেভ হয়। দ্বিতীয়ত, অলোয়েজ অন ডিসপ্লের সুবিধা পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, কালো সবচেয়ে গভীরভাবে প্রকাশ পায় এতে। কারন কালো রঙ যেই পিক্সেল গুলায় থাকে ওইগুলা জ্বলেই না, যেই জিনিসের কোন আলোই নেই এর থেকে কালো নিশ্চই কিছু হতে পারে না। সোজা কথা এমোলেড ডিসপ্লেতে পাবেন সবচেয়ে ডিপ ব্ল্যাক কালার। এই জিনসটা দেখতে জোশ লাগে আমার। এছাড়াও এমোলেড ডিসপ্লে তে কালার খুবই সুন্দর হয়। দেখতে খুবই সুন্দর হয় এই ডিস্পলে। IPS ডিসপ্লের চেয়েও এই ডিসপ্লে চিকন হয় তাই এই ডিসপ্লে যুক্ত ফোন গুলা অনেক স্লিম করা সম্ভব হয়। তবে এইটার Sunlight visibility IPS LCD এর তুলনায় খারাপ হয়ে থাকে সাধারণত।
AMOLED ডিসপ্লের আরেকটা উন্নত সংস্করণ হচ্ছে Super AMOLED Display. সাধারন AMOLED এর চেয়ে এইগুলা আরো কালারফুল ও শার্প হয়ে থাকে। যেকোন কন্টেন্ট দেখতেও খুব সুন্দর লাগে এই ডিসপ্লেতে। বাজারের সবচেয়ে দামি ডিসপ্লে এইগুলা। স্যামসাং এর ফোন গুলায় সাধারণত এই ডিসপ্লে ব্যাবহার করা হয়।
★OLED Display:- OLED এর পুর্নরুপ হলো Organic Light Emitting Diode. OLED ডিসপ্লে মূলত AMOLED ডিসপ্লের মতই কাজ করে। এইটায় ও ডিপ ব্লাক কালার দেয়া যায় সাথে অন্য কালার গুলাও বেশ সুন্দর ভাবে ফুটে উঠে। ভিউইং এংগেল ও ভালো। মোটকথা সব দিক দিয়ে প্রায় পারফ্যাক্ট ডিসপ্লে।
★Retina Diaplay:- রেটিনা ডিসপ্লে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে অ্যাপলের ফোন বা ট্যাবলেট এ। নাম আলাদা হলেও এইটা মূলত IPS ডিসপ্লের প্রযুক্তিতেই কাজ করে। তবে এইটার স্পেশালিটি হচ্ছে খালি চোখে এইটার পিক্সেলগুলো আলাদাভাবে দেখা যায় না। এইখানে হয়তো অ্যাপলের নিজস্ব কিছু টুইক থাকতে পারে। আর IPS এর মত একুরেট কালার, দূর্দান্ত ভিউইং এঙ্গেল তো থাকছেই। তবে Ratina Display ছেড়ে সম্প্রতি অ্যাপল OLED ডিসপ্লের দিকে ঝুঁকছে।
[এই যায়গাটা বোনাস]
প্রায় সব স্মার্টফোনেই ইনপুট দেয়ার জন্য মূলত টাচ ব্যাবহার করা হয়। সাধারণত এই টাচস্ক্রিন দুই ধরনের হয়-
★Resistive Touchscreen:- এ ধরনের টাচস্ক্রীনে দুটি স্তর থাকে। প্রথম ও ২য় স্তরের মাঝে ফাকা স্থান থাকে। প্রথম স্তরে চাপ পড়ার ফলে মাঝের ফাকা অংশটি বেকিয়ে গিয়ে ২য় স্তরে চাপ পড়বে। এবং তারপর মোবাইলের প্রসেসরে সংকেত পাঠাবে। আর এভাবেই এই টাচ কাজ করে। এই টাচস্ক্রিনে আঙ্গুল বাদেও যেকোন কিছু দিয়ে টাচ করে ব্যবহার করা যায়। এই টাচ আর এখন ব্যাবহার করা হয় না। শুরুর দিকের টাচফোন গুলায় এই টাইপের টাচ ব্যাবহার করা হতো। ওইগুলার সাথে আবার ছোট্ট একটা পেন্সিলের মত দিয়া দিত।
★Capacitive Touchscreen:-এ ধরনের টাচ স্ক্রিনে শুধুমাত্র মানুষের হাতের স্পর্শের মাধ্যমেই কাজ করা যায়। এটির ডিসপ্লেতে স্পর্শ করার সাথে সাথেই ইলেক্ট্রোস্টাকিক ফিল্ড তৈরী হয় এবং দ্রুত প্রসেসরে সিগনাল পৌছানোর মাধ্যমে কাজ করে।
বর্তমানে প্রায় সব স্মার্টফোনেই Capacitive Touchscreen ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই টাইপের টাচ ব্যাবহার আরামদায়ক। আর টাচ অনেক স্মুথ ও একুরেট হয়।
সামনে ইনশাআল্লাহ ডিসপ্লে প্রটেকশন নিয়ে কথা হবে।